• সোমবার ০৬ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বন্ধ পাটকল আবার খুলবে     

প্রকাশিত: ৬ মার্চ ২০২২  

দেশের পাটশিল্পের লোকসান ঠেকাতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে ২০২০ সালের জুলাই মাসে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় দেয় সরকার। এরপর বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় আধুনিকায়ন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে দুটি পাটকলের (নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস) ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। এছাড়া আরও দুটি জুট মিলের লিজ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বাকি ১৩টি মিল লিজ দেয়ার জন্য দ্বিতীয় বারের মতো ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করা হয়েছে। পুনরায় চালু করা মিলে অবসায়ন শ্রমিকরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। এই বাস্তবতায় আজ রবিবার দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাট মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, বন্ধ পাটকলগুলো পুনরায় চালু করতে কোন একটি পদ্ধতিকে নির্দিষ্ট করে নয় বরং সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব (পিপিপি), সরকার টু সরকার (জিটুজি), ইজারাসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে বিনিয়োগের সুযোগ রেখে সামনে এগোচ্ছে সরকার। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের ওপর ভিত্তি করে পাটকল শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে সরকারী পাটকলগুলো বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় তারা। ১৭টি পাটকল লিজ দেয়ার জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক আবেদন আহ্বান করে বিজেএমসি। ১৭টি জুট মিলের জন্য ৫১টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। ইতোমধ্যে দুটি পাটকলের (নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস) ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

এছাড়া আরও দুটি জুট মিলের লিজ প্রক্রিয়া চলমান। অবশিষ্ট ১৩টি মিল লিজ দেয়ার জন্য দ্বিতীয় বারের মতো ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- যশোরের কার্পেটিং জুট মিলস, নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলস, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, রাজশাহী জুট মিলস, খুলনার ইস্টার্ন জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস, খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলস, চট্টগ্রামের গুল আহমদ জুট মিলস, চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলস, চট্টগ্রামের এম এম জুট মিলস, খুলনার দৌলতপুর জুট মিলস এবং চট্টগ্রামের আর আর জুট মিলস। যে তিনটি পাটকল লিজ নিতে কোন আবেদনপত্র জমা পড়েনি তার সবই খুলনার। মিলগুলো হচ্ছে- প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস, খালিশপুর জুট মিলস ও স্টার জুট মিলস। আর যে পাঁচটি পাটকল সরকার শুরু থেকেই নিজেদের হাতে রাখতে চেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের বাগদাদ-ঢাকা-কার্পেট ফ্যাক্টরি, ডেমরার করিম জুট মিলস, ডেমরার লতিফ বাওয়ানি জুট মিলস, খুলনার আলীম জুট মিলস ও চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলস।

এই পাঁচটি পাটকলের মধ্যে রাজধানী ঢাকার অদূরে ডেমরায় অবস্থিত করিম জুট মিল, লতিফ বাওয়ানি জুট মিল ও চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলস শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় সেখানকার জমির দাম অন্য মিলগুলোর জমির দামের তুলনায় অনেক বেশি। তাই জমির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এই তিনটি মিল লিজ না দিয়ে সরকার নিজে থেকে কিছু করতে পারে কিনা তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়য়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের নর্থ কাট্টলীতে অবস্থিত বাগদাদ-ঢাকা-কার্পেট ফ্যাক্টরি লিমিটেড নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। তাই এটির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে খুলনার অটরা শিল্প এলাকায় অবস্থিত আলীম জুট মিলসকে কেন লিজ দেয়ার তালিকায় রাখা হয়নি, তা জানা যায়নি।

জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে পাটশিল্পকে লাভজনক ও বেসরকারীকরণ বন্ধ করার কথা বলেছিল। সরকার গঠনের পর তারা বন্ধ দুই পাটকল চালু করে। বেসরকারীকরণ করা তিন পাটকল ফিরিয়ে এনে আবার চালু করে। এ জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়। তবে লাভের লাভ কিছু হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরেই ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান হচ্ছে। গত ১১ বছরেই ৪ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। তার মধ্যে সর্বশেষ পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৫ পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ২০২০ সালের ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে সরকার।

ওই সময় বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় আধুনিকায়ন করে নতুন করে চালু করা হবে। অবসরে পাঠানো শ্রমিকদেরও তখন আবার কাজের সুযোগ হবে। আধুনিকায়নের পর বন্ধ পাটকলগুলোর ফের চালু করার লক্ষ্যে মিল ও বিজেএমসির অন্যান্য সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেই কর্মকৌশল নির্ধারণ এবং বিজেএমসির সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করে প্রয়োজনীয় জনবলের বিষয়ে সুপারিশ দিতে সরকার ইতোমধ্যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দুটি কমিটি কাজ করছে।


জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী  বলেন, ‘অবসায়নের পর মিলগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় লিজ দেয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি পাটকলের (নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস) ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি জুট মিলের লিজ প্রক্রিয়া চলমান। অবশিষ্ট ১৩টি মিল লিজ দেয়ার জন্য দ্বিতীয় বারের মতো ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুততম সময়ে আরও কিছু মিল চালু করা সম্ভব হবে। পুনরায় চালু করা মিলে অবসায়ন শ্রমিকরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে এসব মিলে নতুন করে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকরা দক্ষ। বেসরকারীভাবে যারা আসবে তারা প্রথমে দক্ষ শ্রমিক নেবে। তারপর নতুন শ্রমিক। যেকোন জায়গায় দক্ষ শ্রমিকের খুব টানাটানি আছে। আমরা যে দুটি মিল দিয়েছি, সেখানে এরই মধ্যে দক্ষ শ্রমিকরা কাজে রয়েছে। আমরা সামনে কোন শ্রমিক অসন্তোষ দেখছি না। নতুনভাবে কাজ শুরু হওয়ার পর কোন শ্রমিক অসন্তোষ আমাদের নজরে আসেনি।’

পাট অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৯০ লাখ ৯১ হাজার বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে। তার আগের বছর পাট উৎপাদিত হয়েছিল ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার বেল। বেসরকারী পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬৫ লাখ বেল কাঁচা পাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা চার থেকে সাড়ে চার লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা বাড়ায় ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে সাত লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এরপর থেকে তা আরও বাড়ছে। আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের গত চার মাসে পাট রফতানি আয় ও লক্ষ্যমাত্রা দুটোই কমেছে। এই সময়ে রফতানি আয় এসেছে ৭৯ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) মহাসচিব প্রণব চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, পাট পণ্য রফতানিতে জাহাজ ভাড়া ১০ গুণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে পাটের দামও এবার বেশি। প্রতি মণ তিন-সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের দাম খুব একটা বাড়েনি। এ কারণে আমাদের রফতানিকারকরা এ খাতের পণ্য রফতানি থেকে খুব একটা লাভ পাচ্ছেন না। রফতানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন, তাই রফতানিও কমছে।
কে/

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –